নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ৬ জনসহ স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির ফাঁসির আদেশ হওয়ার পরেও তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যেন শেষ হচ্ছে না।
সেই আলোচিত হত্যাকা-কে ঘিরে এখনও একের পর এক বেরিয়ে আসছে সব গোপন তথ্য। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে মিন্নির পক্ষে-বিপক্ষে নেটিজেনদের মতামত ও যুক্তিতর্ক। তবে মিন্নি কেন্দ্রীক সব যুক্তিতর্কও ছাপিয়ে গেছে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামানের রায়ের পর্যবেক্ষণ। আদালতের পর্যবেক্ষণে মিন্নিকেই হত্যাকা-ের মূল মাস্টারমাইন্ড ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশকে দেয়া মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও হত্যার ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। সেই জবানবন্দিতে রিফাত হত্যার এক নাম্বার আসামি রিফাত ফরাজিকে মিন্নি বলেছেন, ‘অকি ভাইটু! খালি হাতে আসছো কেন?’ হত্যাকা-ের দিন সকালে বরগুনা কলেজের ভেতর এসে রিফাত ফরাজিকে এই কথাটি প্রথম বলেছিলেন মিন্নি। এছাড়া বরগুনা আদালতের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী যখন রামদা দিয়ে ভিকটিম রিফাত শরীফকে কোপাচ্ছিল তখন নয়নকে ঠেকাতে মিন্নির চেষ্টা ছিল অভিনয় মাত্র। এই অভিনয়ের আড়ালে সুকৌশলে আসামি রিফাত ফরাজী যেন ভিকটিম রিফাত শরীফকে আঘাত করতে পারে সেই সহায়তা করে মিন্নি। এর ফলে মিন্নির কারণেই রিফাত নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার বয়সী মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
বরগুনার কনডেম সেল থেকে ঢাকায় মিন্নি
বরগুনার একমাত্র নারী মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। গত মাসে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) কড়া নিরাপত্তায় মিন্নিকে বরগুনা জেলা কারাগার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে আনা হয়। ওইসময় জানা যায়, বরগুনা জেলা কারাগারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নারী বন্দিদের রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মিন্নিকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বেকসুর খালাস চেয়ে হাইকোর্টে মিন্নির আবেদন
আদালতে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়ার পর গত মাসের (৬ অক্টোবর) মঙ্গলবার মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। মিন্নির পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় তার জেড আই খান পান্নার সহযোগী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম এ আবেদন করেন। আবেদনের পরে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছিলেন, আমরা আশাবাদী, যত শিগগির সম্ভব এ মামলার শুনানি হবে, আমরা শুনানি করার চেষ্টা করবো। আমরা আশাবাদী আইনের আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মিন্নি বেকসুর খালাস পাবেন।
ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পরবর্তী প্রক্রিয়া
এর আগে অক্টোবর মাসের রোববার (৪ অক্টোবর) সকালে মিন্নিসহ ৬ আসামির মৃত্যুদ-াদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার সব নথি হাইকোর্টে এসে পৌছায়। এরপর মামলার ডেথ রেফারেন্স থেকে পেপারবুক তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপরেই পেপারবুক তৈরির কার্যক্রম শেষ হলে রায়ে কোনো বিষয় বাদ পড়েছে কিনা সেটা যাচাই-বাছাই শেষে প্রেসে পাঠিয়ে প্রিন্ট করা হয়। তারপর আসামিপক্ষের আপিল আবেদনের উপর শুনানির দিন ধার্য ও বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন প্রধান বিচারপতি। বেঞ্চ নির্ধারণের পরেই এই মামলার নিয়মিত শুনানি শুরু হবে। এতে অন্তত ২-৩ মাস বা এর চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে বলে জানান আইনজীবীরা।
এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদ- দেন। তখন ওই দ- কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। ওই নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে।
বিচারিক আদালতে মিন্নির ফাঁসির রায়ের পর এক ভিডিও বার্তায় তার আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছিলেন, এ মামলা উচ্চ আদালতে এসে টিকবে না। মামলার কাগজপত্র সবেমাত্র পেয়েছি যাচাই-বাছাই করে আমরা শিগগির আপিল ফাইল করতে যাচ্ছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওইসময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে জেড আই খান পান্নার চেম্বারে এসেছিলেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, মোবাইলে একদিন কথা হইছিল মিন্নির সঙ্গে, ফিজিক্যালি দেখা হয়নি। সেদিন তার সঙ্গে কী কথা হয়েছে এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘ও বলতে পারে নাই কিছু, কান্নায় ভাইঙ্গা পড়ছে। ও আব্বু বলার পরে কোনো কথাই বলতে পারে নাই।’
সেই দিন মিন্নির গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক
রায়ে বলা হয়, ভিডিও ফুটেজে থাকা কলেজের গেটের দৃশ্য বিশ্লেষণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। ওই দৃশ্যে আসামি মিন্নি তার স্বামীর সঙ্গে কলেজের গেট দিয়ে বের হয়ে গেটের বিপরীত পার্শ্বে থাকা রিফাত শরীফের মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে তাতে না উঠে গেটের দিকে ফিরে যায় ও কৌতূহল দৃষ্টিতে আশপাশে তাকায়। ওই সময় তাকে ফেরানোর জন্য তার স্বামী পেছনে-পেছনে দৌড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং পরপর আসামি রিফাত ফরাজী গং ভিকটিম রিফাতকে ধরে মারপিট ও টানাহেঁচড়া করতে করতে ক্যালিক্স একাডেমির দিকে নিয়ে যায়। এই সময় মিন্নি তাদের পেছনে-পেছনে এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছিল যেন তেমন কিছুই ঘটছে না এবং তার অঙ্গভঙ্গি ও গতিবিধিতে তার সামনে লোকজন যে তার স্বামীকে ধরে মারপিট করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল তার কোনো প্রতিক্রিয়াই ছিল না। বরং তার হাবভাব ও গতিবিধি দেখে উল্লিখিত ঘটনা তার কাঙ্ক্ষিত মতে ঘটেছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
ফাঁসির রায়ের দিন বরগুনা আদালতে যা ঘটেছে
গত ৩০ সেপ্টেম্বর বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে ছয়জনকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি ছয় আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা দ-েও দ-িত করেন এবং বাকি চারজনকে খালাস দেয়া হয়।
মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বী আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজোয়ান আলী খাঁন হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান ও আয়েশা সিদ্দিকামিন্নি। খালাস পেয়েছেন- মো. মুসা (পলাতক), রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন।
হত্যাকা- থেকে শুরু করে কী ঘটেছিল রিফাত হত্যা মামলার পুরো বিচারিক প্রক্রিয়ায়। কীভাবে সম্পন্ন হলো বিচারিক কার্যক্রম। পুরো ঘটনাচক্রটি তুলে ধরা হলো:
হত্যাকা-
২০১৯ সালের ২৬ জুন সকালে এ হত্যাকা- নজর কেড়েছিল সারাদেশের। কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনীর হাতে খুন হন শাহনেওয়াজ রিফাত (রিফাত শরীফ)। সরাসরি হত্যাকা-ে অংশ নেয় সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীসহ তাদের অনুসারীরা।
সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায়, রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকামিন্নি এ সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন রিফাতকে বাঁচানোর। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে রিফাতকে বরগুনা সদর জেনারেল হাসপাতালে ও পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই দিন বিকেলেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত।
মামলা দায়ের
ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫-৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন নিহত রিফাতের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ। এ সময় মিন্নিকে সাক্ষী করা হয়। মামলাটিতে ক্রম অনুযায়ী আসামি হয়- সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) (২৫), মো. রিফাত ফরাজী (২৩), মো. রিশান ফরাজী (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)।
পুলিশি কার্যক্রম
রিফাত শরীফের ওপর হামলার দিন সন্ধ্যায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে পুলিশ এ ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার শুরু করে। পর্যায়ক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি ও পুলিশ সুপারের দিক নির্দেশনায় একে একে সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ক্রসফায়ার
২০১৯ সালের ২ জুলাই ভোরে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড। এ সময় পুলিশ জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ভোর চারটার দিকে বরগুনা সদর থানার পুলিশ নয়ন বন্ডকে গ্রেপ্তারের জন্য ওই গ্রামে যায়। ওই গ্রামের খলিল মাস্টারের বাড়ির সামনে গেলে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই নয়ন নিহত হয়। হামলায় বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহজাহানসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হন। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
রিফাতের বাবার সংবাদ সম্মেলন
রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় পুত্রবধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জড়িত উল্লেখ করে তাকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান রিফাতের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ। এ সময় তিনি মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়ে ১০টি কারণ উল্লেখ করেন। কারণগুলো হলো:
১. নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের ঘটনা সে ও তার পরিবার কৌশলে গোপন করে গেছে।
২. বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় শরিয়া বহির্ভূতভাবে মিন্নি আমার ছেলে রিফাতকে বিয়ে করেছে।
৩. রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও মিন্নি নয়নের বাসায় যাওয়া আসা করে এবং নিয়মিতভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে; নয়ন বন্ডের মা একাধিক সংবাদ মাধ্যমকে এ বিষয়সহ আরো অনেক তথ্য দিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
৪. এরই ধারাবাহিকতায় মিন্নি ঘটনার আগের দিন ২৫ জুন সকাল আনুমানিক ৯টায় এবং সন্ধ্যায় নয়নের বাসায় যায় বলে আমি জানতে পেরেছি।
৫. মিন্নি অন্যান্য দিনে রিফাতকে ছাড়া কলেজে গেলেও ঘটনার দিন রিফাতকে কলেজে ডেকে নিয়ে যায়।
৬. রিফাত ঘটনার পূর্ব মুহূর্তে মোটরসাইকেলে কলেজ থেকে মিন্নিকে নিয়ে আসার জন্য গেলে মিন্নি মোটরসাইকেল পর্যন্ত এলেও চক্রান্তকারীদের উপস্থিতি না দেখে কালক্ষেপণের জন্য পুনরায় কলেজের দিকে ফিরে যাচ্ছিল এবং রিফাত মিন্নিকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছিল; যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে আপনারা জানতে পেরেছেন।
৭. মিডিয়ায় প্রকাশিত নতুন ভিডিও ফুটেজে দেখলাম প্রথমে যখন আমার প্রিয় ছেলেকে রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও অন্যরা জাপটে ধরে মারপিট করতে করতে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়, তখন মিন্নি অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে পেছনে-পেছনে হাঁটছিল, যা একজন স্ত্রীর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই স্বাভাবিক আচরণ ছিল না।
৮. এছাড়া মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, স্বামীকে কোপানোর সময় মিন্নি আসামিকে জাপটে ধরেছে, কিন্তু আসামি নয়নসহ অন্যন্য আসামিদের কেউই একটি বারের জন্যও মিন্নির ওপর চড়াও হয়নি এবং কোনোভাবেই মিন্নি আক্রান্ত হয়নি।
৯. যখন তার স্বামী রিফাত আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় একা একা রিকশায় হাসপাতালে যাচ্ছিল, তখন মিন্নি তার ব্যাগ ও স্যান্ডেল গোছানোর কাজেই ব্যস্ত ছিল এবং আসামিদের একজন রাস্তা থেকে ব্যাগ তুলে মিন্নির হাতে দিচ্ছিল।
১০. তাছাড়া আমার প্রিয় ছেলে রিফাত শরীফকে অ্যাম্বুলেন্সে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার সময় মিন্নি রিফাতের সঙ্গে বরিশাল যায়নি।
মিন্নির সংবাদ সম্মেলন
১৪ জুলাই বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা মাইঠা এলাকায় নিজস্ব বাসভবনে শ্বশুরের অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন আয়েশা সিদ্দিকামিন্নি। এ সময় তিনি বলেন, ০০৭ গ্রুপ বরগুনায় যারা সৃষ্টি করেছেন তারা খুবই ক্ষমতাবান ও অর্থশালী। তাই তারা বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকার জন্য আমার শ্বশুরকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে রিফাত হত্যার বিচারকে অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। আমি মনে করি, খুনিদের আড়াল করতেই আমার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সময় তিনি তার শ্বশুরের করা সংবাদ সম্মেলনকে ভিত্তিহীন দাবি করেন।
মিন্নি গ্রেপ্তার
২০১৯ সালের ১৬ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেলের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম মিন্নিকে বরগুনা পৌর শহরের মাইঠা এলাকার তার বাবার বাড়ি থেকে পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে। এ সময় তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরকেও সঙ্গে নিয়ে আসা হয়। তবে বেলা ১১টার পর মিন্নির কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকামিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। রাতে বরগুনার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন।
মিন্নির জামিন
২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকামিন্নির দুটি শর্তে জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। শর্ত দুটি হলো- মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না ও তাকে তার বাবার জিম্মায় থাকতে হবে। হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জামিনে থাকা অবস্থায় মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে তার জামিন বাতিল হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করেন আদালত।
পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল (চার্জশিট)
রিফাত হত্যাকা-ের দুই মাস ছয়দিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল করেন পুলিশ। এদের মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। একইসঙ্গে রিফাত হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
চার্জ গঠন
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। অন্যদিকে গত ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত।
সাক্ষ্যগ্রহণ
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। মামলার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ, ডাক্তার ও সিআইডি কর্মকর্তাসহ ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেন আদালত।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও রায়ের তারিখ নির্ধারণ
সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পুনরায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক খ-ন করেন ১৬ সেপ্টেম্বর। এই দিনই আদালতের বিচারক রিফাত হত্যা মামলার তারিখ নির্ধারণ করেন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক শেষে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করে আদালত।
Leave a Reply